কুমিল্লার খাদি
প্রাচীনকাল থেকে এই উপ-মহাদেশে হস্তচালিত তাঁত শিল্প ছিল জগদ্বিখ্যাত। দেশের চাহিদা মিটিয়ে সব সময় এই তাঁতের কাপড় বিদেশেও রপ্তানি হতো। একটি পেশাজীবী সম্প্রদায় তাঁত শিল্পের সাথে তখন জড়িত ছিলেন। তাদেরকে স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘যুগী’ বা ‘দেবনাথ’। বৃটিশ ভারতে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনের সময়কালে ঐতিহাসিক কারণে এ অঞ্চলে খাদি শিল্প দ্রুত বিস্তার লাভ ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তখন খাদি কাপড় তৈরি হতো রাঙ্গামাটির তূলা থেকে। জেলার চান্দিনা, দেবিদ্বার, বুড়িচং ও সদর থানায় সে সময় বাস করতো প্রচুর যুগী বা দেবনাথ পরিবার। বিদেশি বস্ত্র বর্জনে গান্ধীজীর আহ্বানে সে সময় কুমিল্লায় ব্যাপক সাড়া জাগে এবং খাদি বস্ত্র উৎপাদনও বেড়ে যায়। দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে কুমিল্লার খাদি বস্ত্র। এই বস্ত্র জনপ্রিয়তা অর্জন করে কুমিল্লার খাদি হিসাবে।
গান্ধীজী প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লার অভয় আশ্রম খাদি শিল্প প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অনুশীলন চক্রের আশ্রয় স্থল হিসেবে ছদ্ম বরণে প্রতিষ্ঠিত সমাজ কল্যাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভয় আশ্রম প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদেশি কাপড় বর্জনের ডাকে যখন ব্যাপক হারে চরকায় সূতা কাটা শুরু হয়। অভয় আশ্রম তখন সুলভে আশ্রমে তৈরি চরকা বাজারে বিক্রির পাশাপাশি নিজেরাও তৈরি করতে থাকে খাদি বস্ত্র। বিভিন্ন গ্রামে তৈরি খাদি বস্ত্রও এ সময় অভয় আশ্রমের মাধ্যমে বাজারজাত করতে শুরু করে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ১৯২৬-২৭ সালে একটি ৮ হাত লম্বা ধুতি বিক্রি হতো মাত্র পাঁচশিকে দামে। সে সময় কুমিল্লা অভয় আশ্রম প্রায় ৯ লাখ টাকা মূল্যের খাদি কাপড় বিক্রি করেছিল। প্রয়াত রবীন্দ্র সংগীত বিশারদ, অভয় আশ্রমের একজন কর্মী পরিমল দত্তের লেখা থেকে জানা যায়, বিপুল চাহিদা থাকলেও অভয় আশ্রম থেকে সে চাহিদা সম্পূর্ণভাবে পূরণ হতো না।
খাদির দ্রুত চাহিদার কারণে দ্রুত তাঁত চালানোর জন্য পায়ে চালিত প্যাডেলের নীচে মাটিতে গর্ত করা হতো। এই গর্ত বা খাদ থেকে যে কাপড় উৎপন্ন হতো সেই কাপড় খাদি। এভাবে খাদি নামের উৎপত্তি। ক্রমান্বয়ে এই কাপড় খাদি বা খদ্দর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় খাদি শিল্পের ছিল স্বর্ণযুগ। এর পরপরই আসে সংকটকাল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বস্ত্রকলগুলো তখন বন্ধ। বস্ত্র চাহিদা মেটাতে আমদানি নির্ভর দেশে হস্তচালিত তাঁতের কাপড়ের উপর প্রচুর চাপ পড়ে। দেশের বা মানুষের চাহিদার তুলনায় খাদির উৎপাদন ব্যাপক না হলেও চান্দিনা বাজারকে কেন্দ্র করে আশ-পাশের গ্রামগুলোতে তাঁতীরা চাদর, পর্দার কাপড়, পরার কাপড় তৈরি করতে শুরু করে। স্বাধীনতার পূর্বে খাদির চাহিদা শীত বস্ত্র হিসেবে ব্যাপক ছিল। খাদি বস্ত্রের চাহিদের সুযোগে এ অঞ্চলের কতিপয় অতীত সরকারের দেয়া সুতা, রং এর লাইসেন্স গ্রহণের সুবাধে মুনাফা লুটে মধ্যস্বত্ব ভোগী হিসেবে। সুলভ মূল্যে সুতা ও রংয়ের অভাবে প্রকৃত তাঁতীরা সে সময় তাদের মূল পেশা বদল করতে বাধ্য হন । আশির দশকের মাঝামাঝি দেশে ব্যাপক হারে পাওয়ার লুম ভিত্তিক বস্ত্র শিল্প গড়ে উঠে। ফলে অতুলা জাত বস্ত্রের প্রসার ব্যাপক হারে ঘটে। বেড়ে যায় পলিয়েস্টার, রেয়ন, ভিসকম এ্যাক্রেলিক সুতার ব্যবহার। রপ্তানি মুখী তৈরি পোশাকের জন্য আমদানি হতে থাকে শুল্ক মুক্ত বিদেশি বস্ত্র। এভাবে খাদ থেকে খাদি নামের যে বস্ত্রের প্রসার ঘটেছিল তা হারিয়ে যায় বিলুপ্তির খাদে।
কুমিল্লার খাদি শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটলেও এই শিল্প মূলত কুটির শিল্প। গ্রাম্য বধূরা গৃহস্থালি কাজের ফাঁকে ফাঁকে চরকায় সুতা কেটে তাঁতীদের কাছে বিক্রি করে বাড়তি আয়ের সুযোগ পেত। যে বৃদ্ধ লোকটি খেতে খামারে পরিশ্রম করতে পারত না, যে কিশোর- কিশোরী বাইরে শ্রম বিক্রির সুযোগ পেত না তারাও চরকায় সুতা কেটে সংসারে বাড়তি আয়ের সুযোগ পেত।
উনিশ শতকে ত্রিপুরার ঘোষ সম্প্রদায়ের হাত ধরে রস মালাইএর প্রচলন হয়। সে সময় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে মিষ্টি সরবরাহের কাজটা মূলত তাদের হাতেই হত। মালাইকারির প্রলেপ দেয়া রসগোল্লা তৈরি হত সে সময়। পরে দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি ক্ষীরের মধ্যে ডোবানো রসগোল্লার প্রচলন হয়। ধীরে ধীরে সেই ক্ষীর রসগোল্লা ছোট হয়ে আজকের রসমালাই এ পরিণত হয়েছে ।
কুমিল্লার মৃৎ-শিল্প
বাংলার লোকশিল্পের আবহমান সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের অন্যতম কুমিল্লার মৃৎশিল্পের বিভিন্ন পণ্য । প্রাচীনকাল থেকেই কুমিল্লায় তৈরীকৃত গৃহস্থালি তৈজসের মধ্যে কলসি, হাঁড়ি, জালা, সরাই বা ঢাকনা, শানকি, থালা, কাপ, বদনা, ধূপদানি, মাটি নির্মিত নানা খেলনা এবং ফল, পশু-পাখি ইত্যাদি বিখ্যাত ছিল । তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় তা ক্রমশ ম্রিয়মাণ হতে থাকলে ১৯৬১ সালে ডঃ আখতার হামিদ খান বিজয়পুর রুদ্রপাল মৃৎশিল্প সমবায় সমিতির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী এটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭৫ হাজার টাকা অনুদান দিলে সমিতিটি আবার ঘুরে দাড়ায়। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে সমবায় মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় এখানে গড়ে তোলা হয়েছে - মৃৎ-শিল্প প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে বছরের বিভিন্ন সময়ে ২০জন করে বেশ কয়েকটি ব্যাচে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এক পক্ষ কালব্যাপী প্রশিক্ষণ শেষে একেকজন কুমার হয়ে উঠেন একেকজন দক্ষ শিল্পী।
বর্তমানে কুমোরেরা বিভিন্ন শোপিস এর পাশাপাশি ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের মুর্তি, সিরামিকস কালার, দীর্ঘস্থায়ী সেনেটারী লেট্রিনের চাক, পানির ট্যাংকি ,টাইলস ইত্যাদি তৈরী করছেন।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS